কুসুমের জ্ঞান ফিরতেই সে খেয়াল করলো সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।আশেপাশে তাকাতেই দেখলো রাফসানের বাবা আর রায়া দাঁড়িয়ে আছে।সব থেকে অবাক করা বিষয় বেডের সামনের চেয়ারে রাফসান বসে আছে।
কুসুম বুঝতে পারছে না সে স্বপ্ন দেখছে কিনা।নিজের হাতে চিমটি কাটতে গিয়ে দেখে স্যালাইনের নল হাতে লাগানো।তার মনের কথাটা বুঝতে পেরে রাফসান বলে,
-তুমি স্বপ্ন দেখছো না সব সত্যি।
-কিন্তু!
-কিন্তু কি?
-তোমার তো এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।
-হ্যাঁ।
-কিন্তু তুমি তো সুস্থ।আসলে কি হচ্ছে আমার সাথে।
-দাঁড়াও বোঝাচ্ছি তোমাকে।
এই বলে রাফসান রায়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করে।রায়া ইশারার মানে বুঝতে পেরেই বাবার দিকে তাকায়।তারপর বলে,
-বাবা তোমার তো অনেক ধকল গেলো।সারারাত ঘুমোও নি।চলো চা খাইয়ে আনি।
-হ্যা তাই চল।
রায়া বাবাকে নিয়ে বের হয়ে গেলেই দুহাত দিয়ে কুসুমকে আঁকড়ে ধরে রাফসান।তারপর রাগী গলায় বলে,
-এসব কি পাগলামি করেছো তুমি কুসুম?কেনো করেছো?আমার সাথে থাকা কি এতোটাই অসম্ভব যে নিজেকে শেষ করে দিতে গেছিলে?আমাকে বললে আমি নিজেই তো ছেড়ে দিতাম তোমাকে।
-তুমি আমাকে ভুল বুঝছো রাফসান।আমি তো ভেবেছিলাম তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো।আর তাইতো!
উত্তেজনায় কুসুম বুঝতেই পারে নি সে রাফসানকে তুমি বলে ফেলেছে।কুসুমের মুখে তুমি শুনে রাফসান তো অবাক।
হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
-কি বললে?
-কই কি বললাম?
-তুমি আমাকে তুমি বললে!
-ওহ সরি।খেয়াল করিনি।
-এবার যদি তুমি থেকে আবার আপনি বলেছো আমি কিন্তু সত্যিই তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।
রাফসানের মুখ চেপে ধরে কুসুম এক হাত দিয়ে।
-খবরদার না।কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তোমার এক্সিডেন্ট এর খবরটা কি মিথ্যে ছিলো?
-উঁহু। এক্সিডেন্ট হয়েছে তবে গুরুতর না।অফিসের সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি করে নেমে বাড়ি আসছিলাম।হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়।পরে দু চার জন স্টাফ আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে।তেমন কিছুই হয়নি।শুধু গোড়ালির হাড় ফেটে গিয়েছে এক জায়গায় আর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছে।তুহিন ফোন করে সেই খবরটা দিতেই গেছিলো কিন্তু বাবা সবটা না শুনে ফোন কেটে দেয়।এরপর বাবার ফোন বন্ধ পায় তুহিন।
এতোক্ষণে কুসুম খেয়াল করলো রাফসানের বাম পায়ে ব্যান্ডেজ।
-তোমার খুব লেগেছে। তাই না?
-একদম লাগেনি।ডাক্তার বলেছে ২১ দিন বেড রেস্ট নিলেই ফিট হয়ে যাব।
-কিন্তু একটা জিনিস মাথায় ঢুকছে না আমি এখানে কিভাবে এলাম?
-হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ঘরে ঢুকতে গিয়েই দেখি বাইরে থেকে দরজা লাগানো।ভেতরে গিয়েই দেখি তুমি ওই অবস্থায় পড়ে আছো।তারপর তোমাকে সবাই মিলে হাসপাতালে নিয়ে আসি।সেই কাল রাত থেকে এই শরীর নিয়ে বসে আছি তোমার কাছে।তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও কুসুম।তোমার এই অবস্থার জন্য আমার মা দায়ী।আমি জানি মায়ের কথায় কষ্ট পেয়েই এমনটা করেছো তুমি।
-উঁহু ভুল জানো তুমি।মায়ের কথায় আমি এসব করিনি।ওনার যা মনের অবস্থা ছিলো তাতে এই ব্যাবহারটাই স্বাভাবিক।
-তবে কিসের রাগ ছিলো তোমার কুসুম?কেনো এমন করলে?
-আমি তো ভেবেছিলাম সায়নের মতো তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছো।আর তাই তো নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিলাম।
-কিন্তু আমি চলে গেলে তোমার কি আসে যায়?
-আসে যায়।
-কেনো এসে যায়?
-কারণ আমি ভালবাসি তোমাকে।অনেক ভালবাসি।তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
-কিহ!কি বললে তুমি?
-ভালবাসি প্রিয়।
-এবার সম্ভবত আমি স্বপ্ন দেখছি।
-মোটেও না।কালকে তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম।সেজেছিলাম ও তোমার জন্য।
-ওহ শিট।বউয়ের সাথে রোমান্স করার বড় সুযোগটাই হারিয়ে ফেললাম।কি কপাল আমার!
-তুমি কথা দাও আমাকে ছেড়ে যাবা না।তাহলে এমন সুযোগ রোজ আসবে।
-ইশ!এতো সহজে কে ছাড়ছে আপনাকে ম্যাডাম।তবে তুমিও কথা দাও এমন পাগলামি আর করবে না।
-তুমি পাশে থাকলে করবো না।
-গুড গার্ল।
-শোনো।
-কি?
-আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?
-ওলে বাবা।কি মিষ্টি আবদার।
তারপর কুসুমকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় রাফসান।
এমনসময় রায়া আর রাফসানের বাবা হাজির।
ওদের এই অবস্থায় দেখে রাফসানের বাবা লজ্জা পেয়ে দরজার কাছ থেকে সরে যায়।আর রায়া দুহাতে মুখ ঢেকে বলে,
-ইশ!ভুল সময়ে এন্ট্রি নিয়েছি।
রায়ার কথায় লজ্জা পেয়ে দুজন দুজনকে ছেড়ে দেয়।
এর মাঝে বেশ কয়েকটা দিন কেটেছে।রাফসান এখন অনেকটাই সুস্থ।আগামী সপ্তাহ ব্যান্ডেজ কাটতে যাবে সে।এই কটা দিন কুসুম প্রাণপাত করে সেবা করেছে রাফসানের। বলতে গেলে কুসুমের সেবায় রাফসান এতো দ্রুত সুস্থ হয়েছে।
তবে এসব একদম ভালো লাগছে না সোয়েদা বেগমের।এই মেয়েকে তিনি তাড়াতে চেয়েছিলেন।কিন্তু স্বামী আর ছেলেমেয়ের জন্য পেরে উঠছেন না কিছুতেই।
সন্ধ্যাবেলায় পান চিবুচ্ছিলেন আর সেসবই ভাবছিলেন সোয়েদা বানু।হঠাৎ বোন আমেনার ডাকে ভাবনায় ছেদ ঘটে তার।
-কিরে আপা কি ভাবছিস?
-না কিছুনা।
-বলছি কি অনেকদিন হয়ে গিয়েছে এসেছি।আদিল এর আব্বু(আমেনা বেগমের স্বামী) চলে যেতে বলছে।কি করি?
-তুই চলেই যা।এমনিতেও তোকে রেখে কাজের কাজ কিছুই হয়নি আমার।ওই মেয়ে দিব্যি সুখে সংসার করছে।সেইসাথে আমার স্বামী আর ছেলেমেয়েকে হাত ও করে নিয়েছে।ওকে তাড়াতে পারিস নি তুই।
-আরে সে ব্যাবস্থাও ভেবে ফেলেছি।তোর সাথে পরামর্শ করতেই আসা।যাওয়ার আগে কাজ সেরেই যাব।
-আর বড় বড় কথা বলিস না।
-মোটেও বড় কথা বলছি না।যা একটা বুদ্ধি এঁটেছি। ওই মেয়েকে সংসার থেকে নয় পৃথিবী থেকেই তাড়িয়ে দেবো।কাকপক্ষীতেই টের পাবে না...
-তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আমেনা?কিসব যা তা বলছিস।
-যা তা কেনো হবে আপা?ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে আমাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।
-দেখ মেয়েটাকে আমি পছন্দ করি না ঠিকই কিন্তু মানুষ খুন করবো কেনো?তাছাড়া লোক জানাজানি হলে কোমরে দড়ি পড়বে।সে খেয়াল আছে তোর?
-আরে না।তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো?আমার কাছে ভালো একটা প্ল্যান আছে।আগে শুনেই দেখ।
-কিন্তু!
-কোনো কিন্তু না।তুই শোন।ওই মেয়ে প্রতিদিন সকালে সবার আগে উঠে রান্নাঘরে যায় তো?
-তা যায়।
-আমাদের বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু রাতে ঘুমানোর আগে গ্যাসের পাইপটা লিক করে আসবো।সারারাত রান্নাঘরে একটু একটু করে গ্যাস ছড়াবে। সকালে চুলা জ্বালাতেই ওর ভবলীলা সাঙ্গ।ওতো ভোরে তো কেউ ওঠে না। আর রাফসানের পক্ষে ওই পা নিয়ে দ্রুত ছুটে আসা সম্ভব ও নয়।সবাই এটাই ভাববে অসাবধানতাবশত আগুন লেগে মারা গিয়েছে মেয়েটা।আমাদের কেউ সন্দেহ করবে না।
-এসব না করলে হয় না?
-একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ আপা।আজকে ওই মেয়ে তোর স্বামী আর ছেলেমেয়েকে হাত করেছে।কিন্তু এমন একদিন আসবে গোটা সংসারটাই ও হাতে নিয়ে নেবে।আর সেদিন তোর কোনো জায়গা থাকবে না এই সংসারে। এখন তুই যদি তাই চাস তো ঠিক আছে দরকার নেই এসবের।
-না না আমার সংসার আমি কখনো কারো হাতে যেতে দেবো না।
-তাহলে রাজি হয়ে যা।
-ঠিক আছে। যা ভালো বুঝিস কর।
এই কথা বলে সোয়েদা বেগম দরজার দিকে তাকালেন।এমনসময় তিনি খেয়াল করলেন দরজার আড়াল থেকে একটা ছায়া সরে গেলো।গলাটা শুকিয়ে এলো সোয়েদা বানুর কিছুটা অপরাধবোধ আর কিছুটা চিন্তায়।
আবার বলে উঠলেন তিনি,
-না থাক দরকার নেই।
-আবার কি হলো?
-মনে হয় আমাদের কথা কেউ শুনে ফেলেছে।পর্দার আড়াল থেকে আমি একটা ছায়া চলে যেতে দেখলাম।
-আরে ধুর।কেউ শুনলে বাইরে থেকে চলে যেতো নাকি।তোর মন দুর্বল হয়ে আছে তাই এমন দেখছিস।
-হবে হয়তো।
আর কথা বাড়ালেন না সোয়েদা বেগম।
সারাদিনের সব কাজের পর,রাতে সবাইকে খেতে দিয়ে, রান্নাঘরের সব কাজ সেরে সবে রাফসানের খাবার নিয়ে ঘরে এসেছে কুসুম।এই কয়দিনেই সংসারের সব কাজের দ্বায়িত্ব সে তুলে নিয়েছে নিজের ঘাড়ে।
এদিকে কুসুম বেড়িয়ে যেতেই নিজেদের প্ল্যানমাফিক কাজ সেরে নিলো দুইবোন।যদিও সোয়েদা বেগমের মনে সংশয় কাজ করছে কিন্তু বোনের কাছে সে অসহায়।আর যাই হোক বোন তো তার ভালোর জন্যই এসব করছে।
ঘরে এসে কুসুম দেখলো রাফসান বসে বসে মোবাইলে গেইমস খেলছে।কুসুম গিয়ে হাত থেকে মোবাইল টা কেড়ে নিলো।তারপর রাগী গলায় বললো,
-ঘরে বসে আছো বলে এই যন্ত্রটাই ব্যবহার করতে হবে এমন কোন কথা আছে?কোরআন-হাদিস পড়তে পারো,গল্পের বই পড়তে পারো। তা না কিসব আজেবাজে গেইমস।ওসব রেখে খেয়ে নাও।
-তুমি খাইয়ে দাও।
-ফ্র্যাকচার টা পায়ে হয়েছে।হাতে নয়।সেটা মনে আছে তো?
-তো?আমার বউয়ের হাতে আমি খাব।কোন শালা কি বলবে?
-ইশ!মুখের কি ভাষা!
-তাতে কি হয়েছে।নিজের বউয়ের সামনেই তো বলছি।আর তাছাড়া তোমার ভাই ও তো আমার শালা।শালা খারাপ ভাষা না।আদরের ডাক।
-হয়েছে হয়েছে।আর ভাষাচর্চা করতে হবে না।নাও তো হা করো।
-তুমি খাবে না?
-আগে খেয়ে নাও। খেয়ে ঘুমাও।তারপর খাব।
-উঁহু। আমার সাথেই খাবে।এই প্লেট থেকেই খাবে।কারণ খাওয়ার নাম করে তুমি আরও দেরী করবে।আমার আবার বউকে না জড়ালে ঘুম হয়না।
-তাই বুঝি!
-হুম তাই তো।
-যদি কখনো আমি না থাকি কি করবা তুমি?এতো নির্ভরশীল হইও না আমার ওপর। যদি আমি না থাকি তোমাকে তো বাঁচতে হবে।
-তুমি আবার কোথায় যাবে?
-কোথায় আর যাব।মানুষের হায়াত মওত এর কথা কি বলা যায়।আজ আছি, কাল নেই।
-একদম চুপ।আবার যদি এইসব বলেছো খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।আর আমার আল্লাহ পরম দয়ালু, অসীম করুণাময়। আমার তার ওপর ভরসা আছে।তিনি এতো সহজে আমার ভালবাসা কেড়ে নেবেন না।
বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো রাফসানের।চোখ দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।রাফসানের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে কুসুম বললো,
-ধুর।এই পাগল,আমি এখনো মরিনি।
খাওয়া শেষ হতেই প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো কুসুম।মৃত্যুর কথা তার কেনো মনে হলো সে নিজেও জানে না।তবে তার মনের মধ্যে কেমন যেন কু ডাকছে।মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে।
পরের দিন সকালবেলা কুসুমের ঘুম ভাঙতে সে দেখলো রাফসান তাকে জড়িয়ে ধরে শান্তি করে ঘুমাচ্ছে।রাফসানের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে আগালো সে।তারপর ওযু করে নামায পড়ে নিলো সে।ফজরের নামায পড়ে উঠে যাচ্ছিল কুসুম সকালের কাজের উদ্দেশ্যে।আবার কি মনে করে কুরআন শরীফ এর দিকে নজর গেলো তার।খুব ইচ্ছে হলো তিলাওয়াত করার।
রাফসানের ঘুম সবে ভেঙেছে কুসুমের মিষ্টি সুরের তিলাওয়াতে।
কুসুমের তিলাওয়াত শুনতে খুব ভালো লাগছে তার।ঘুম ঘুম স্বরে রাফসান বললো,
-বাহ কুসুম।তুমি তো খুব সুরেলা গলায় তিলাওয়াত করো।
-হুম।আমার নবী করীম (সঃ) বলেছেন,তোমাদের মধ্যে যে সুর করে তিলাওয়াত করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়।
-এই হাদিস টা তো আমি জানতামই না।আর তাছাড়া তোমার তিলাওয়াত শুনতে ইচ্ছে করছে আরো।
-আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি যখন উঠেই পড়েছো তাহলে তোমার চা টা বানিয়ে আনি।চা খেতে খেতে তিলাওয়াত শুনলে ভালো লাগবে।
এই বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো কুসুম।
রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় পানি বসিয়ে সবেমাত্র গ্যাস অন করতে যাবে কুসুম।এমনসময় কুসুমের শ্বশুর এসে ডাক দিলো।
-বৌমা।
-হ্যাঁ বাবা।চা খাবেন তো?দাঁড়ান গ্যাস টা অন করে আসি।
-না বৌমা।তুমি গ্যাস অন করবে না।
-কেনো বাবা?
-দাঁড়াও বলছি।আগে অন্যদের ও ডাকি।
রাফসানের বাবা চিৎকার করে ডাকতে থাকলেন সবাইকে। ডাক শুনে রায়া, রাফসান সবাই ছুটে এলো।রাফসান ক্রেসে ভর দিয়ে কোনোমতে আসতে পেরেছে বটে তবে এসেই ডাইনিং এর চেয়ারে বসে পড়লো।
এদিকে সোয়েদা বেগম আর আমেনা বেগম নিশ্চিত নিশ্চয় কুসুম এর গায়ে আগুন লেগেছে।তাই তারাও ছুটে এলো।কিন্তু এসে কুসুমকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে গেলো দুই বোন।
রাফসান আর রায়া হা করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে।জন্ম থেকেই তারা দেখে এসেছে তাদের বাবা শান্তশিষ্ট মানুষ। সবকিছু সমঝোতায় মিটিয়ে নেন।সেই মানুষকে এভাবে চেঁচাতে দেখে দুজনেই অবাক।
বিস্মিত গলায় রাফসান জিজ্ঞেস করলো,
-বাবা কি হয়েছে তোমার?তুমি তো এইভাবে চেঁচাও না।
-কি হয়েছে সেটা তোর মা আর খালাকে জিজ্ঞেস কর।আমি এক্ষুণি পুলিশে ফোন দেবো।
-কিন্তু কেনো বাবা?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। হয়েছে টা কি?মা তুমি কিছু জানো?
ভয়ে একপাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমেনা বেগম আর সোয়েদা বেগম।
সোয়েদা বেগম আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন,
-ক...ই না..না তো।
-বাবা তুমি প্লিজ বলবে কি হয়েছে এভাবে রহস্য না করে?
-কি হয়েছে শুনলে অবাক হয়ে যাবি।তোর মা আর খালা বৌমাকে খুন করার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
কথাটা শোনামাত্র কুসুম,রাফসান, রায়া তিনজনেই অবাক হয়ে গেলো।
-কি যা তা বলছো বাবা?মাথা ঠিক আছে?
রাফসান বললো।
-আমি ঠিকই বলছি।কাল রাতে দুই বোন মিলে গ্যাসের পাইপ লিক করে রেখেছে।যাতে বৌমা গ্যাস জ্বালানো মাত্রই গায়ে আগুন লেগে মারা যায়।কি বৌমা তুমি রান্নাঘরে গ্যাসের গন্ধ পাওনি?
-হ্যা একটু গন্ধ পেয়েছি।কিন্তু!
-কোনো কিন্তু না।এসব আমি কাল রাতে নিজের কানে শুনেছি।ভেবেছিলাম সোয়েদা বোনের কথায় রাজি হবে না।২৭ বছরের সংসার জীবনে এটুকু বিশ্বাস ছিলো।কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম একটা ভুল মানুষের সাথে এতোবছর সংসার করেছি আমি।ছিহ!
- বাবা যা বলছে তা কি সত্যি মা?তুমি সত্যিই এই জঘন্য কাজটা করেছো মা?
সোয়েদা বেগম চুপ করে আছেন।একটাও কথা বলছেন না।আজ নিজের মানুষদের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন তিনি।পাশ থেকে আমেনা বেগম উত্তর দিলেন,
-মোটেই না।আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে দুলাভাই?
-প্রমাণ?প্রমাণ লাগবে?ঠিক আছে।এখন তুমি নিজে গ্যাস জ্বালিয়ে আমাকে প্রমাণ করবে আমি ভুল।
আমেনা বেগম দুই কদম পিছিয়ে গেলেন।তারপর বললেন,
-আ..আমি কেনো জ্বালাবো।আমি পারবো না।আপা তুই কিছু বল।
পাশ থেকে সোয়েদা বেগম উত্তর দিলেন,
-হ্যা রাফসানের আব্বা তুমি যা বলছো সব সত্যি।আমরা কুসুমকে মারতে চেয়েছিলাম।
কথাটা শোনামাত্র রাফসানের মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠলো।আর কোনো কথা বললো না সে।
-আমি এক্ষুণি পুলিশে ফোন করছি।আশা করি কারো কোনো আপত্তি নেই।
রাফসানের বাবা বললেন।
পাশ থেকে কুসুম বলে উঠলো,
-বাবা আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?ঘরের ব্যাপার ঘরেই মেটান।পুলিশ ঢুকলে বাড়ির সম্মান থাকবে?আর তাছাড়া আমার কোনো অভিযোগ নেই মায়ের ওপর।কোন মা চাইবে ছেলে একটা বিধবা,অপয়া নিয়ে সংসার করুক।আমি মা হলে হয়তো আমিও চাইতাম না।আর এখানে আসার পর যে সম্মান আপনি,আপনার ছেলে আর রায়া আমাকে দিয়েছে সেটাই তো আমার জন্য বেশী। আপনি মাকে একদম দোষ দেবেন না।বরং আপনার ছেলে সুস্থ হলে আমি চলে যাব।মায়ের অমতে আমি সংসার করতে চাই না বাবা।
-কুসুম আর একটা কথা বললে এই মুহুর্তে তোমাকে আমি তালাক দেবো।
রাগী গলায় বললো রাফসান।
রাফসানের কথা শুনে কুসুম চুপ হয়ে গেলো।রাফসান আবার বললো,
-যে বাড়িতে আমার বউয়ের প্রাণের নিরাপত্তা নেই।সেই বাড়িতে থাকবো না আমি।তোমার সংসার নিয়ে তুমি থাকো মা।আমার বউকে নিয়ে আমি আজকেই চলে যাব।
-তুমি কি পাগল হলে!আমি কোথাও যাব না।
-ঠিক আছে তুমি যেতে না চাইলে আমি একাই যাব।তবে মনে রেখো কুসুম এই মুহুর্তে আমার সাথে না বের হলে তুমি আমাকে সারাজীবনের মতো হারাবে।
এই বলে রাফসান নিজের ঘরে চলে গেলো।কুসুমও অনুসরণ করলো রাফসানকে।এতো বড় কথার পর তো আর কিছু বলার থাকে না।
এদিকে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন সোয়েদা বেগম।তার আজ কিছুই বলার নেই।নিজের একটা ভুলের জন্য স্বামী,সন্তান সবাই আজ তার বিরুদ্ধে কথা বলছে।
-ছিহ মা।আমার লজ্জা লাগছে ভাবতে এসব তুমি করেছো।
এই বলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো রায়া।
রায়া চলে যেতেই রাফসানের বাবা আমেনা বেগমের কাছে এসে বললেন,
-এই মুহুর্তে তুমি আমার সংসার ছেড়ে চলে যাবে।আর যদি এই বাড়িতে পা দিয়েছো তোমার স্বামীকে এসব জানাতে বাধ্য হবো আমি।কলেমা পড়ে তোমার বোনকে বিয়ে করে তার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলাম।এই বয়সে তো তালাক দিয়ে লোক হাসাতে পারবো না।তবে আর কোনোদিন ভালোও বাসতে পারবো না।কিন্তু তোমাকে আর চোখের সামনে দেখতে চাইনা আমি।
স্বামী চলে যেতেই মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লেন সোয়েদা বেগম।এক লহমায় তার প্রিয়,চেনা মানুষগুলো পর হয়ে গিয়েছে।অথচ তাদের জন্যই কুসুম মেয়েটাকে তাড়াতে চেয়েছিলেন তিনি।লজ্জায়,ঘেন্নায়,অনুশোচনায় তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
৭৩০ টা দিন মানে দুইটা বছর।হ্যা গুনে গুনে দুইটা বছর নিজের বাড়িতে পা রাখেনি রাফসান।সেইসাথে নিজের মায়ের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি।সেদিন কুসুমকে নিয়ে ওই অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় রাফসান। কারো কোনো কথায় টলেনি সে সেদিন।তবে এই দুইবছরে সে বাবামায়ের প্রতি কর্তব্যে ত্রুটি রাখেনি।ঠিক সময়ে সংসার খরচসহ যার যা লাগবে পাঠিয়েছে।কুসুম অবশ্য অনেকবার রাফসানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু রাফসান শোনেনি।
এই দুইটা বছরে পুত্রশোক আর অনুশোচনায় ক্রমশ দগ্ধ হয়েছেন সোয়েদা বেগম।শুধু তাই নয় নিজের চোখে বোনের পরিনতি দেখেছেন তিনি।আমেনা বেগমের ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন বছর দেড়েক।এর মধ্যে শ্বাশুড়ি মাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে তার পছন্দ করে আনা ছেলের বউ।
কুসুমের অবশ্য ননদ আর শ্বশুরের সাথে ভালো যোগাযোগ আছে।এই দুই বছরে সুখ উপচে পড়েছে কুসুম আর রাফসানের ছোট্ট সংসারটাই। সেই সংসারে আজ আসতে চলেছে নতুন অতিথি।কুসুম মা হতে চলেছে।৮মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে।কুসুম এখন নিজের হাতে কিছুই করতে পারে না।তাই পালা করে কুসুমের মা আর চাপা থাকে কুসুমের কাছে।চাপা আর অনিককে অবশ্য মেনে নিয়েছে বাড়ির সবাই।মাস ছয়েক আগে বেশ ভালো বেতনের একটা চাকরী ও যোগাড় করেছে অনিক।এখন তাদের একটাই চাওয়া। চাপার কোল আলো করে আসুক একটা সন্তান।তবেই ষোলকলা পুর্ণ হয়।চাপা অবশ্য বলেছে আগে আপার বাচ্চাটা মানুষ করে দেবে তারপর নিজেরটার চিন্তা।
এদিকে রাফসানের সন্তান আসার খবর রায়ার কাছ থেকে জেনেছেন সোয়েদা বেগম।কথায় আছে আসলের চেয়ে সুদের দাম বেশি।ঠিক তেমনি রাফসানের চেয়ে রাফসানের সন্তানকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেশি হয় সোয়েদা বেগমের।ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা কাথা সেলাই করেছেন তিনি।আজকাল স্বামীর পেছনে লেগে থাকেন সেই কাথাগুলো ও বাড়িতে দিয়ে আসার জন্য।
ভদ্রলোক অবশ্য স্ত্রীর এই পরিবর্তনে খুশি।শুধু ছেলেটা যদি বুঝতো!
রাফসানের মধ্যে আজকাল বাবা বাবা ভাব এসেছে।নিজের অনাগত সন্তানের জন্য হাজারটা চিন্তা হয় তার।কুসুম আজকাল কিছু খেতে পারে না,তবুও সন্তানের জন্য জোর করে খায়।তাছাড়া বাচ্চার জন্য ঠিকভাবে ঘুমাতেও পারে না।কুসুমকে দেখে রাফসানের আজকাল খুব মায়ের কথা মনে পড়ে। তার মা ও ঠিক এভাবেই তাকে দুনিয়ার মুখ দেখিয়েছে।ইচ্ছে করে মায়ের কাছে ছুটে যেতে।কিন্তু ওই যে ইগো!ওটাই তো বাধা দেয়।
কুসুমের আজ ডেলিভারি। খুব সুন্দর ফুটফুটে একটা ছেলে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে সে।একদম রাফসানের মতো ফরসা আর মায়াকাড়া মুখ হয়েছে ছেলেটার।
কুসুমের মা বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছে। আর ঠিক পাশের বেডে শুয়ে আছে কুসুম।রাফসান ঠিক তার পাশেই বসে আছে কুসুমের হাতটা ধরে।ওটিতে নিয়ে যাওয়ার সময় কয়েক মুহুর্তের জন্য কুসুমকে হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছিলো তার।তাই কুসুমকে বেডে দেওয়ার পর থেকেই হাত ধরে বসে আছে সে।
এমনসময় স্বামী আর মেয়ের সাথে কুসুমের কেবিনে ঢুকলেন সোয়েদা বেগম।মাকে দেখে রাফসান উল্টোদিকে ফিরে রইলো।সব লাজ লজ্জা ভুলে ছেলের কাঁধে হাত দিলেন সোয়েদা বেগম।তারপর বললেন,
-মাকে আর কতো শাস্তি দিবি বাবা?আমার দাদুভাইয়ের জন্য ও কি ক্ষমা করা যায় না?
রাফসান আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।পেছন ঘুরে জড়িয়ে ধরলো মাকে।তারপর সেই ছোট্টবেলার মতো কাঁদতে লাগলো।মা ছেলের এতোদিনের মান অভিমানের পালা বুঝি শেষ হলো।
কুসুমের চোখেও পানি।
সোয়েদা বেগম ধীর পায়ে কুসুমের কাছে এগিয়ে গিয়ে বসলেন।তারপর বললেন,
-মা রে অপয়া বলে তোকে অনেক অপমান করেছি।কিন্তু আজ বুঝেছি তুই আমার ঘরের লক্ষী।আমাকে মাফ করে দে মা।কিন্তু আমার দাদুভাইকে আলাদা করিস না আমার থেকে।ওকে নিয়ে ফিরে চল।কথা দিচ্ছি অভিযোগের সুযোগ দেবো না।
তারপর কুসুমের মায়ের কাছ থেকে রাফসানের ছেলেকে নিলেন রাফসানের মা।নাতীকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি।ঠিক রাফসানের ছোট বেলার মুখটা বসানো।
নাতির মুখ দেখে তিনি বললেন,
-দাদুভাইয়ের তো নাম রাখা লাগবে।
পাশ থেকে রায়া উত্তর দিলো,
-ওর নাম আমি ঠিক করে ফেলেছি।ওর নাম হবে রায়ান।ফুফির রায়ান।
রায়ার কথায় মুখ বাঁকিয়ে চাপা বললো,
-এই যে বেয়ানসাব।এই কয় মাস কষ্ট করলাম আমি আর নাম হবে আপনার সাথে মিলিয়ে!মোটেই না। ওর নাম হবে খালামনির সাথে মিলিয়ে।ওর নাম হবে চাঁদ।
-না রায়ান।
-না না চাঁদ।
-রায়ান।
-চাঁদ।
এভাবেই খুনসুটিতে মেতে উঠলো পুরো পরিবার।আজ যে তাদের খুশির দিন।
(সমাপ্ত)



0 comments:
Post a Comment