"অপয়া"-তামান্না ইসলাম।।পর্ব-০১

"বিয়ের এক মাসের মধ্যে যে মেয়ে স্বামীকে খেয়ে বসে থাকে তাকে কি বলে জানিস?অপয়া।আর তুই ঠিক তাই।মরতে পারিস না তুই?"

কথাটা বলে কুসুমের সামনে থেকে ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেললো ওর মা রাবেয়া বেগম।সারাদিনের কাজের শেষে মাত্রই কচুর শাক দিয়ে ভাত মেখে খেতে বসেছিলো সে।

কুসুম তেমন কিছুই মনে করলো না।শুধু বা হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে হাঁটা দিলো বাইরের দিকে।গন্তব্য! পুকুরের পাশের আমবাগান পেরিয়ে কবরস্থানটা।


গত এক বছর ধরে এসব সহ্য করে আসছে সে।গা সওয়া হয়ে গিয়েছে তার এসব।আসলে বাবা মা অবিবাহিত মেয়েকে বছরের পর বছর খাওয়াতে পারে কিন্তু বিবাহিত মেয়ে বাবা মা এর বোঝা।তারপর কুসুম বিধবা হয়ে এসে বসে আছে বাবা মা এর অভাবের সংসারে।হাজার কাজ করলেও দুবেলা দু মুঠো ভাত খেতে যেন যুদ্ধ করতে হয় তাকে।


কুসুমের বাবা সাবের আলী একজন ভাগচাষী।পরের জমিতে থেকে যেটুকু আয় হয় এই দিয়ে সংসার চলে।তার ওপর ঘাড়ে ৩ টা সন্তান। সবাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন তিনি।কুসুম তার বড় মেয়ে,ছোট মেয়ে চাপা আর একটা ছোট ছেলে আছে বছর দশেকের।

সাবের আলী ১ বছর আগে অনেক টাকা খরচ করে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছিলেন বড় মেয়ের  এই গ্রামের সবথেকে ভালো ছেলেটার সাথে।ভেবেছিলেন মেয়েটা খুব সুখী হবে।কুসুমের অবশ্য সুখের কমতি ও ছিলো না।কুসুমের স্বামী সায়ন প্রচণ্ড ভালোবাসতো তাকে। কিন্তু হতভাগীর কপালে সুখ সইলো না।বিয়ের ২৬ দিনের মাথায় বিধবা হলো সে।ফিরে আসলো বাপের বাড়ি।সেই থেকে মেয়েটা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।কিন্তু একটু ও সুখ পায়নি।


কিছুদিন পর সাবের আলীর বাড়িতে আবার বিয়ে।কুসুমের ছোটবোন চাপার বিয়ে হবে ১ সপ্তাহ পর।গ্রামের মানুষ বলে কুসুম নাকী অপয়া।তাই গ্রামের কোন শুভ অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না তাকে।রাবেয়া বেগমেরও আজকাল তাই মনে হয়।বারবার মনে হয় অপয়া বড় মেয়েটার জন্য ছোট মেয়েটার বিয়েতে গণ্ডগোল হবে না তো?ফলস্বরুপ প্রায়ই কুসুমের সামনে থেকে ভাতের থালা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেন তিনি।তার ওপর নানা অত্যাচার তো আছেই।কুসুম অবশ্য মুখবুজে সহ্য করে এসব।অবশ্য তারই বা কি করার আছে!

প্রায়ই কুসুমের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে।কেউ দোজবরে,কারও ঘরে সন্তান আছে অথবা কেউ ঘাটের মরা।প্রত্যেকটা প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় সে।সায়নের স্মৃতিটুকু আঁকড়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায় সে।তাতে মায়ের সাই না পেলেও বাবার প্রশ্রয় আর ভাইবোনেদের সমর্থন ঠিক পায় সে।



সবেমাত্র  প্রাইভেট শেষ করে বাড়ি এসেছে চাপা।এইচএসসি দেবে সে এবার।বড় মেয়েকে অনার্সে ভর্তি করেছিলেন সদরের কলেজে।তাই হয়তো বিধবা হয়েছে।এমনটাই ভাবেন রাবেয়া বেগম।তাই ছোটমেয়ের বিয়ে টা তিনি ইন্টারের আগেই দিয়ে দিতে চান।বাড়ি ফিরেই চাপা কুসুমকে ডাকতে শুরু করলো,

-আপা,এই আপা।

-কিরে কি হয়েছে? আপাকে খুজচ্ছিস কেনো?

-আপা কোথায় মা?

-জানিনা আমি।দেখ কোথায় আছে।

-মা,তুমি আজও আপাকে খেতে দাও নি।তাইনা?বারান্দায় ভাত পড়ে আছে।তুমি কি চাও মা?ওকে কি মেরে ফেলতে চাও?


রাবেয়া বেগম কোনো কথা বললেন না।আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন রান্নাঘরে।মেয়েটা এ বাড়িতে ফিরে আসার পর ভালো মুখে কথা বলেননি তিনি ঠিকই।কিন্তু কুসুম তো তার নিজের মেয়ে।কষ্ট তারও হয়।বুকটা ফেটে যায় ওই হতভাগীর জন্য।


চাপা খুব ভালো করে জানে কুসুম কষ্ট পেলে কোথায় যায়।তাই দেরী না করে চলে এলো কবরস্থানে।গিয়ে দেখলো সায়নের কবরের পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে কুসুম

আর বিলাপ করছে,

"আপনি কেনো আমাকে ছেড়ে গেলেন।আমাকে নিয়ে গেলেন না কেনো।আমার যে আপনাকে ছাড়া খুব কষ্ট হয়।আমার দুঃখের কথা আমি কারে বলবো।কি নিয়ে বাঁঁচবো আমি।রোজ রোজ তিলে তিলে মরার চেয়ে একবারে মরে গেলেও তো শান্তি পাইতাম।"


দূর থেকে দাঁড়িয়ে কুসুমের কান্না দেখছে চাপা।১ বছর আগেও কুসুম ছিলো হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে।কিন্তু আজ সেই কুসুমই মনে করতে পারেনা শেষ কবে হেসেছে।

আচ্ছা!ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া বেঁচে থাকা কি সত্যিই খুব কষ্টের!তাহলে সে কি সুখী হবে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে?তাহলে কি করবে সে?আপার মতো ভালোবাসা ছাড়া বাঁচার চেষ্টা করবে নাকি ভালোবাসার মানুষ এর হাত ধরবে?

আর কিছু ভাবতে পারে না চাপা।ধীরপায়ে এগিয়ে যায় কুসুমের কাছে।


চাপার উপস্থিতি টের পেয়ে কুসুম চোখের পানি মুছে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,

-কিরে বোনু তুই এখানে?


-মা আজও খেতে দেয়নি তোকে?


-কই না তো।আমি খেয়েছি।


-আমাকেও মিথ্যা বলবি?


এই পর্যায়ে,ডুঁকরে কেঁদে উঠলো কুসুম।কাঁদতে কাঁদতে বললো,

-মায়ের আর কি দোষ বল?বিধবা হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে আছি তারপর আবার সামনে তোর বিয়ে।সবাই ভাবছে আমার জন্য তোর বিয়েতে বাধা পড়বে।


-তুই ও কি তাই ভাবছিস আপা?


-কি জানিস তো বোনু।সবাই মিলে একটা মিথ্যাও যদি কানের কাছে সবসময় বলতে থাকে সেটা একসময় সত্যি মনে হয়।আর তাছাড়া সবাই তো ভুল বলে না।আমার সাথে বিয়ে না হলে সায়ন হয়তো বেঁচে আজকে থাকতো।আর আমারও মনে হয় আমি অপয়া।তা না হলে ৩ ঘর পরেই আমার শ্বশুড়বাড়ি।অথচ দেখ সেখানেও আমার জায়গা হলো না স্বামীর মৃত্যুর পর।


-একদম চুপ।অনেক হয়েছে।বাড়ি চল।


বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দুবোন দেখতে পেলো ওদের বাবা ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।

-কিরে মা কোথায় গিয়েছিলি দুবোনে?


-সামনেই।জানো বাবা মা আজও আপাকে খেতে দেয়নি।


-হুম শুনলাম।তার আর দোষ কি বল।নানা লোকে কান ভারী করে।মায়ের কথায় রাগ করিস না মা।চল খেয়ে নিই।


সাবের আলী দুই মেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছেন।দূর থেকে বাবা আর মেয়েদের ভালোবাসা দেখছেন রাবেয়া বেগম।তার চোখে পানি চিকচিক করছে।কুসুম তারও নিজের মেয়ে।মেয়েটাকে অনেক যত্নে বড় করেছেন তিনি।সেই মেয়ের কপালে এতো কষ্ট হবে কে জানতো।কিন্তু মায়ের অভিশাপ এর মধ্যেও দুয়া থাকে।রাবেয়া বেগম প্রত্যেক নামাজের মোনাজাতে দোয়া করেন কুসুমের দুর্দশা যেন কেটে যায়।তিনি বিশ্বাস করেন তার এই অপয়া,অভাগী মেয়ে ও একদিন রাজরাণী হবে।শুধু যদি বিয়েতে রাজি হতো! 


মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় চাপার।ঘুম ভেঙেই কুসুমকে দেখতে পায় না সে।ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পুকুরপাড়ের দিকে।হয়তো সেখানে বসেই নিজের অতীতে ফিরতে চেষ্টা করছে কুসুম।


কুসুম সেদিন কলেজ থেকে ফিরছিলো বান্ধবীদের সাথে।রাস্তায় এলাকার কিছু বখাটে খুব জ্বালাচ্ছিলো তাদের।আর সেদিনই সিনেমার নায়ক এর মতো তাদের সামনে এসেছিলো কুসুমদের প্রতিবেশী সায়ন ভাই।

সায়নকে দেখেই পালিয়ে গিয়েছিলো ছেলেগুলো।আর সেদিন থেকেই কুসুম এর বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো সায়ন।যদিও আগে টুকটাক কথা হতো।কিন্তু তারপর থেকেই তাদের কথা বলা বাড়তে থাকে।আর কুসুমের ও কিশোরী মনে সিনেমার নায়কের জায়গা দখল করে নিয়েছিলো সায়ন।কুসুম আসার সময় ইচ্ছে করেই নানা অযুহাতে বান্ধবীদের সাথে আসতো না।এমনি একদিন বান্ধবীদের ফাঁকি দিয়ে কুসুম এসে দাঁড়িয়েছিল মোড়ের মাথায় ঠিক যেখানটায় সায়ন দাঁড়াতো।কুসুম কে দেখেই মুখে কপট রাগ এনে সায়ন বলেছিলো,

-কি রে তোর সাঙ্গপাঙ্গ কই?


-একাই এসেছি।


-কেনো রে?ঝগড়া করেছিস।


-উহু।


-তবে?


-জানিনা।


-আচ্ছা শোন,একা চলাফেরা করিস না।ছেলেগুলো ভালো না।আবার বিরক্ত করতে পারে।


-তাতে কি।তুমি তো আছো।


-সবসময় যদি আমি না থাকি?


-থাকতে হবে।


-আমার কিসের দায় তোর রক্ষা করার?তোর বাপে কি আমারে তোর ঠেকা দিয়ে রাখছে?


-ঠেকা নিলেই হয়।কে বারণ করছে?


-কি বললি?


-কিছু না।


সেদিনের মতো ছুটে পালিয়েছিলো কুসুম লজ্জায় রাঙা হয়ে।আর সায়ন?কতশত স্বপ্ন বুনেছিলো সেই চঞ্চল,উচ্ছল কিশোরীকে নিয়ে।তারপর?

(অপয়া পরের পর্ব আসবে,তাই poesy এর সাথেই থাকুন)

0 comments:

Post a Comment